গভর্নরের কাছে খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে আড়াই মাসেও তা না পাওয়ায় উষ্মা প্রকাশের পাশাপাশি ঋণ খেলাপিদের নানা সুযোগ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে উচ্চ আদালত।
গত ২০ বছরে কোটি টাকার উপরে ঋণ খেলাপি, ঋণের সুদ মওকুফ, অর্থপাচার ও অর্থপাচারকারীদের তালিকা এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিলের জন্য গত ১৩ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট।
বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাই কোর্ট বেঞ্চের সেদিনের আদেশে ব্যাংক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা রোধে কমিশন গঠন করতেও বলা হয়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ সচিবসহ ছয় বিবাদী আড়াই মাসেও ওই প্রতিবেদন দিতে পারেননি।
এই অবস্থায় ঋণ খেলাপিদের সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার জারির বিষয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে রিট আবেদনকারী পক্ষ একটি সম্পূরক আবেদন করে।
মঙ্গলবার ওই আবেদনের শুনানিতে বিচারকরা ওই প্রতিবেদন না পেয়ে এবং কমিশন গঠনে কোনো অগ্রগতি না দেখে উষ্মা প্রকাশ করেন।
বিচারক বলেন, “দেশে বড় বড় রাঘব বোয়াল আছেন, যারা ব্যাংক লুট করে ফেলল, অথচ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আমরা দেখছি ব্যবস্থা না নিয়ে আরও বেশি করে ঋণ দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। এটা কেন?”
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার (অবলোপনসহ) বেশি, যে অঙ্ক চলতি অর্থবছরের বাজেটের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।
অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার পর সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ অবলোপন নীতিতে পরিবর্তন আসে, যা ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সুযোগ করে দেয়।
ঋণ খেলাপিদের মোট ঋণের ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ১২ বছরে ওই টাকা পরিশোধের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ব্যবসায়ীরা চাইলে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরও ছয় মাস টাকা না দিয়ে খেলাপিমুক্ত থাকতে পারবেন।
এই বিষয়গুলোই আদালতের নজরে এনে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. মনিরুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
![](https://d30fl32nd2baj9.cloudfront.net/media/2017/05/08/high-court_mm_180516_0008.jpg/ALTERNATES/w300/High+Court_MM_180516_0008.jpg)
বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বিচারক বলে, সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্টে যখন নাম আসছে না, তখন ঋণ খেলাপিদের অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। ঋণ খেলাপিদের তালিকা চেয়েছি, সেটা যাতে দাখিল করতে না হয় সেজন্য কি এই সময়সীমা বাড়ানো?
এ পর্যায়ে মনজিল মোরসেদ বলেন, ঋণ খেলাপিদের তালিকা যাতে ছোট থাকে সেজন্যই হয়ত এই পদক্ষেপ।
তখন মনিরুজ্জামান বলেন, এটা সত্য নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব ব্যাংকের কাছে ঋণ খেলাপিদের তালিকা চেয়েছে।
আদালত তখন জানতে চায়, ৩০ দিনের মধ্যে কমিশন গঠন করতে বলা হয়েছিল, তার কী হয়েছে?
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনজীবী তখন বলেন, “এটা এখনও আদেশ পাইনি।”
বিচারক বলেন, “এভাবে উচ্চ আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করবেন? আমরা যদি কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রাখি সেটা কি শোভনীয় হবে? আপনি তো আদালতের আদেশ ঠিকভাবে পড়েননি। তাহলে কীভাবে ক্লায়েন্ট ডিফেন্ড করবেন?”
এরপরই কমিশন গঠনের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, ১৫ দিনের মধ্যে তা প্রতিবেদন আকারে দাখিলের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনজীবীকে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট।
ব্যাংক খাতে অর্থ আত্মসাৎ, ঋণ অনুমোদনে অনিয়ম, সুদ মওকুফ সংক্রান্ত বিষয় তদন্ত ও সুপারিশ প্রনয়নে কমিশন গঠন করার আদেশ চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ এই রিট আবেদনটি করে।
ওই আবেদনে রুল জারির পাশাপাশি গভর্নরের প্রতি নির্দেশনা ছিল
# এক কোটি টাকার উপরে ঋণ খেলাপিদের নাম, ঠিকানা, তালিকা আদালতে দাখিল করতে হবে।
# অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে কী কী ব্যবস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে এবং এখন পর্যন্ত কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে সে বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।
# ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং ঋণের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে যে অনিয়ম চলছে, তা বন্ধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।
মঙ্গলবার শুনানির পর মনজিল মোরসেদ বলেন, “যখন তাদের কাছে (ব্যাংকগুলোর কাছে) গত ২০ বছরের ঋণ খেলাপিদের তালিকা চাওয়া হল, তার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার ইস্যু করে সময় দিয়ে ঋণ খেলাপিদের অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিল।
“আমি মনে করি এর মাধ্যমে বিচারাধীন মূল মামলাটিকে অকার্যকর করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ যখনই সময় দেওয়া হল তখন তো সে আর ঋণ খেলাপি থাকবে না। তখন আদালতে যে তালিকা আসবে সেখানে তো তার নাম থাকবে না। এভাবে তাদেরকে ঋণ খেলাপি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার একটি সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “গত দুদিন সংসদে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য এবং বিভিন্ন রিপোর্টে ব্যাংকের যে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ফেরত দেওয়া হচ্ছে না, আলোচনায় এসেছে।
“এত আলোচনা হওয়ার পরও, আদালত রুল জারি করার পর এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকরি কোনো পদক্ষেপ বা ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয় নাই। এজন্য আদালত উষ্মা প্রকাশ করেছেন।”
No comments:
Post a Comment