অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
পুঁজিবাজার ‘ঠিকই আছে’ দাবি করে সাংবাদিকদের দোষারোপ করার এক সপ্তাহের মাথায় সংসদে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বললেন অন্য কথা।
রোববার সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি স্বীকার করলেন, দেশের পুঁজিবাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই, ব্যাংক খাতের অবস্থাও নাজুক।
আওয়ামী লীগের এমপি আহসানুল ইসলাম টিটুর একটি সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, কোনো দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ার প্রথম প্রতিফলন দেখা যায় পুঁজিবাজারে। পুরো পৃথিবীতেই পুঁজিবাজার ও অর্থনীতি এভাবে সম্পৃক্ত থাকে।
“আমাদের দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত চাঙ্গা। অত্যন্ত শক্তিশালী। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফ আমাদের অর্থনীতি দেখে উচ্ছ্বসিত। তারা অন্য দেশগুলোকে বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে বলেছে।
“আমাদের এই এগিয়ে যাওয়া থমকে যাবে যদি পুঁজিবাজারকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারি। পুঁজিবাজারটি এখন নিয়ন্ত্রণে নেই। তবে, সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেই সেটাও বলব না। পুঁজিবাজারের যেসব সমস্যা আছে তা চিহ্নিত করেছি। একে একে সবগুলি সমস্যার সমাধান দেব।”
তিনি বলেন, সরকার সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে যতটা যত্নশীল, পুঁজিবাজার নিয়েও ততটাই আন্তরিক।
পুঁজিবাজারের সঙ্গে সম্পৃক্তদের নিয়ে সভা করার কথা জানিয়ে মুস্তফা কামাল বলেন, “আরো মিটিং করব। আর দশটি দেশে পুঁজিবাজার যেভাবে চলে আমরাও সেইভাবে চালানোর চেষ্টা করব। এক্ষেত্রে যেসব জায়গায় বিচ্যুতি আছে তা অবশ্যই দূর করা হবে।
“...সঙ্গত কারণেই পুজিবাজারের জন্য আগামী বাজেটে প্রণোদনা থাকবে। তবে কতটা থাকবে তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। অবশ্যই পুঁজিবাজারকে শক্তিশালীভাবে চালানোর জন্য যা কিছু দরকার সেটাই করা হবে।”
দীর্ঘদিন মন্দা দশার পর জাতীয় নির্বাচনের আগে ১৭ ডিসেম্বর থেকে দেশে পুঁজিবাজারের সূচক বাড়তে শুরু করে। ৩০ ডিসেম্বর ভোটের পর বাজার চাঙ্গাভাবে ফিরে আসে। ২৪ জানুয়ারি ডিএসইএক্স বেড়ে ৫৯৫০ পয়েন্ট হয়।
কিন্তু ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতি ঘোষণার পর থেকেই বাজারে পতন শুরু হয়। রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন শেষ হয় সূচকের ঘরে ৫ হাজার ২৩৮ পয়েন্ট নিয়ে।
এই তিন মাসে ঢাকার বাজারে সূচক কমেছে ৭১২ পয়েন্ট বা প্রায় ১২ দশমিক ৫২ শতাংশ। লেনদেন কমতে কমতে ৩৪৪ কোটি টাকায়, যা জানুয়ারির শেষ দিকে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় উঠেছিল।
এই পরিস্থিতিতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের একটি সংগঠন রোববারও মতিঝিলে ডিএসই ভবনের সামনে বিক্ষোভ করে। সেখান থেকে সোমবার ডিএসইর সামনে প্রতীক অনশনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
কিন্তু গত ২২ এপ্রিলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দাবি করেন, পুঁজিবাজার ঠিকই আছে, যে ওঠানামা হচ্ছে সেটা স্বাভাবিক।
“আপনারা তো পত্রিকায় লিখতেছেন যে পুঁজিবাজার নাই; বাংলাদেশ নাই। আমরা নাই- এরকম লেখালেখি শুরু করছেন। কোথায় সেরকম ঘটনা ঘটছে? মার্কেট কোথায় ফল করছে?
![ফাইল ছবি](https://d30fl32nd2baj9.cloudfront.net/media/2016/06/02/sangsadnationalparliament.jpg/ALTERNATES/w300/Sangsadnationalparliament.jpg)
ফাইল ছবি
দেশের পুঁজিবাজার এই মুহূর্তে ‘সঠিক জায়গায়’ আছে দাবি করে তিনি সেদিন বলেন, “এক সময় পিই ৮০-৯০ এ চলে গেছিল; এখন পিই আছে ২০ এর নিচে, ১৫ এর ঘরে। এটা খুব ভালো অবস্থা।”
‘স্বীকার করতে দোষ নেই’
খেলাপি ঋণ আর অনিয়ম নিয়ে বেকায়দায় থাকা ব্যাংক নিয়েও এদিন কথা হয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে।
অধুনালুপ্ত ফারমার্স ব্যাংক প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, “কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক দেউলিয়া হোক সরকার তা চায় না।
যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক বাঁচাতে যে পরিমাণ সহযোগিতা করা দরকার সরকার তা করবে।
“ফারমার্স ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে বলে যে এর উত্তরসূরি পদ্মা ব্যাংকও ব্যর্থ হবে তেমন নয়। সরকার আশা করছে, পদ্মা ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে। যারা ফারমার্স ব্যাংকে টাকা রেখেছিলেন তারা অবশ্যই সে টাকা ফেরত পাবেন। পদ্মা ব্যাংক সে টাকা ফেরত দিতে বাধ্য।”
শহীদুজ্জামান সরকারের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, “সুদের হার এ মুহূর্তে সবার দুশ্চিন্তার জায়গা। প্রধানমন্ত্রী সুদের হার নিয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছেন, সে অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অংকে নামিয়ে আনা হবে। এ বছরই এর সুফল দেখা যাবে।”
অর্থমন্ত্রী বলেন, যেভাবে ঋণের সুদ নির্ধারণ করা হয় তাতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সরল সুদের ওপর ‘কমপাউন্ড সুদ’ নেওয়া যাবে না। পয়লা জুলাই থেকে এ নিয়ম কার্যকর হবে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অতীতে অনেক বিষয়ে অনেক কমিটি হয়েছে, তবে সুরাহা হয়নি। সরকার এখন ব্যাংক খাত নিয়ে কাজ শুরু করেছে। সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। সমাধানের জন্য কাজ করা হচ্ছে।
ফলে ব্যাংক কমিশন গঠন করার প্রয়োজন আর হবে না বলে মনে করছেন বর্তমান অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল।
ইসরাফিল আলমের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের ব্যাংক খাত অনেকের ধারণায় নাজুক অবস্থায় আছে। এটা আমাদের স্বীকার করতে দোষ নেই। প্রত্যেক দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। একটি উন্নয়নশীল দেশে সবগুলো খাতকে সুন্দর ও সমভাবে পরিচালনা করা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। এর মধ্যেও আমাদের ব্যাংক খাত খারাপ করছে তা বলব না।
ঋণের সুদের হার কমাতে সরকার কাজ করছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “শিগগিরই সারা বিশ্বের সঙ্গে সমন্বিত করে অত্যন্ত কম্পিটেটিভ রেট আমরা করব। সেই রেট অব ইন্টারেস্ট বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের ইতিহাসে আর্থিক খাতের জন্য সেটা হবে টার্নিং পয়েন্ট।
“আর এটাকে না করতে পারলে আমাদের বারবার এভাবে রাইটঅফের কথা চিন্তা করতে হবে। এত নন-পারফর্মিং লোন অনেক বেড়ে যাবে। দুর্বল জায়গাগুলো আরো দুর্বল হতে থাকবে। আমরা চাই না সেই কাজটি আর হোক।“
মোকাব্বির খানের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সব ব্যবসায়ীকে জেলে পাঠিয়ে দিয়ে দেশের অর্থনীতি চালানো যাবে না। তবে আবার সবাইকে মাফও করা যাবে না।
“যারা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে, কঠোর অবস্থানে যেতে হবে।”
No comments:
Post a Comment